রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৫:৩২ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

গণতন্ত্রের দুর্বলতায় কর্তৃত্ববাদী শক্তি মাথাচাড়া দেয়

মনোয়ারুল হক:
পাকিস্তানের বিদায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া রাওয়ালপিন্ডিতে এক আলোচনায় স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত দেশের রাজনীতির গুণগতমান উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। সামরিক বাহিনী এই সিদ্ধান্ত নেয় তার সময়কালে। তিনি স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ চলছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পরাজিত হয়নি, পরাজিত হয়েছে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা। তিনি একদিকে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন, অন্যদিকে ’৭১-এর সব দায়ভার রাজনীতিবিদদের ওপরই চাপিয়েছেন। তবে এটাও ঠিক, ইমরান খানের গ্রেপ্তারের পর আন্দোলনকারীরা স্থানীয় এক সেনাক্যাম্প পুড়িয়ে দেওয়ার পরও সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়নি। এখন দেখার বিষয়, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপমুক্ত পাকিস্তানের রাজনীতি কতদূর যেতে পারে?

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণের ইতিহাস অনেক লম্বা। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কানদার মির্জা সামরিক আইন জারি করেছিলেন এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মহম্মদ আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। এর পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। নিয়োগপ্রাপ্তির ২০ দিনের মাথায় ২৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মির্জাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে আইয়ুব নিজেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হন। এটাই পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিকীকরণের সূচনা। ১৯৬৮-৬৯ তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় ২৫ মার্চ ’৬৯ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব সামরিক আইন জারি করেন। সামরিক বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো তৃতীয়বারের মতো সামরিক শাসন জারি করেন। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউল হক, জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন। পাকিস্তানে সামরিক শাসনের চতুর্থ ঘটনা এটি।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে সরিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মুশাররফ রাষ্ট্রীয় কর্র্তৃত্বভার নেন ’৯৯ সালের ১২ অক্টোবর। তিনি সরাসরি সামরিক আইন জারি না করলেও রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হন। জেনারেল মুশাররফ সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতার মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রধান বিচারপতিকে বরখাস্ত করেন এবং সামরিক আইনে পরিবর্তন এনে সেনাবাহিনীর হাতে আরও ক্ষমতা প্রদান করেন।

১৯৪৭ সালে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাত ধরে। সামরিক কর্র্তৃত্ব তখনো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে তখন দেশে দেশে জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুটি প্রধান হয়ে সামনে আসতে থাকে। এই সময়ে বিশ্বের বহু দেশে রাজনীতিতে সামরিক কর্র্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। পাকিস্তানেও এমন প্রবণতা বাড়তে থাকে। ’৫৮ সালেই জেনারেল আইয়ুব রাজনৈতিক নেতৃত্ব সরিয়ে পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং ’৬২তে রাজনীতিতে সামরিক কর্র্তৃত্ব ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিষয়টি সংবিধানে সন্নিবেশিত করেন। এরপর যারাই পকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছেন, প্রায় সবাই সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক অংশীদারত্ব ও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেই ক্ষমতায় থেকেছেন। তারপরও পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের অব্যবহিত পর থেকেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ’৪৭-এর অক্টোবরেই কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সদ্য স্বাধীন দুই দেশ ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ২ মাসের মাথায় যুদ্ধে লিপ্ত হয়। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় জম্মু ও কাশ্মীরকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার প্রথম যুদ্ধের আপাত পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান পরস্পরের বিরুদ্ধে আরও তিনটি আনুষ্ঠানিক যুদ্ধে লিপ্ত হলেও অদ্যাবধি যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে দুই দেশ। এই ‘যুদ্ধ পরিস্থিতিই’ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে তার অবস্থান ‘যৌক্তিক’ করে তুলেছে। এই যৌক্তিক অবস্থানের সুযোগ পুরোমাত্রায় কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশ খরচ করা হয় সেনাবাহিনীর পেছনে।

কৃষি, শিল্প, অবকাঠামো তৈরি ও সেবা খাতসহ প্রায় সব ব্যবসা কার্যক্রম রয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। আগেই বলেছি, জাতীয় বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ প্রতিরক্ষা বাজেট। এ ছাড়াও রয়েছে মোটা অঙ্কের পেনশন ভাতা। অনেক বিশ্লেষক মজা করে বলেন, পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হলেন প্রধানমন্ত্রী! তাহলে প্রথম কে? প্রথম আসলে সেনাবাহিনী। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী সেনাবাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে এমনি অবস্থা বিরাজ করছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুর্বলতার ফলে সেনাবাহিনী ক্রমান্বয়ে ধনী সেনাবাহিনীতে রূপান্তরিত হচ্ছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ৪০ বছর পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক কর্র্তৃত্বে দেশ পারিচালিত হয়েছে। ৫২ বছরের বাংলাদেশেরও ১৮ বছর কেটেছে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন ও সেনা প্রভাবেব মধ্য দিয়ে। পাশাপাশি আমাদের পার্শ^বর্তী দেশ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ এশিয়ার আরও অনেক দেশ সামরিক শাসন বা সামরিক প্রভাবের মধ্যে থেকেছে। তবে এটাও উল্লেখ করা দরকার, প্রতিটি দেশের মানুষ কর্র্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা মেনে নেয়নি। এই অঞ্চলের মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে যা অনেক দেশে এখনো চলমান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক সরদার ফজলুল করিমের একটি উক্তি এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য ‘গণতন্ত্র হলো, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম’। অর্থাৎ গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম সব সময়ই জারি রাখতে হবে। ছেদ পড়লেই কোনো না কোনোভাবে আবারও কর্র্তৃত্ববাদী শাসনের আগমন ঘটবে।

শুধু ব্যতিক্রম ভারত। নিজস্ব হাজারো সমস্যা ভারতের। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন, অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদের সমস্যা, সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন, ধর্মীয় কর্র্তৃত্ববাদের প্রশ্ন তারপরও সেখানে সামরিক শাসন বা সামরিক কর্র্তৃত্ব দৃশ্যমান নয়। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদী ও কাশ্মীর প্রশ্নে সামরিক বল প্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে। ভারত লম্বা সময় ধরে তার দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলোকে শক্তিশালী করতে পেরেছে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ বা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ভারতে দৃশ্যমান। বিচারপতি নিয়োগ, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন ও নির্বাচন কমিশন নিয়োগ বা অন্যান্য কমিশন গঠন ও নিয়োগ প্রক্রিয়াগুলো ভারত একটি কাঠামোর মধ্যে আনতে পেরেছে। কমিশনগুলোর ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব ও পছন্দ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সাধারণ মানুষ সেগুলো গ্রহণ করে নেয় এবং একটা আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ বা নিম্ন আদালতের বিচারকের পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদি বিষয় ভারতে নির্বাহী বিভাগের সরাসরি কোনো হস্তক্ষেপ নেই। নির্বাহী বিভাগের সরাসরি হস্তক্ষেপের বাইরে একটা ব্যবস্থার মধ্যে আনতে পেরেছে তারা। সে কারণে বিচারকরা অনেক বেশি স্বাধীনভাবে বিচার কাজ পরিচালনা করতে পারেন। ক্ষমতাসীনদের অনুরাগ বা বিরাগভাজনের চিন্তা করতে হয় না। ফলে বিচার বিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের একটি আস্থার জায়গা তৈরি করেছে। গণতান্ত্রিক একটি কাঠামোগত ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরও ভারতের নানা বিষয়ে এখনো বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার চিরকালের স্বীকৃত পদ্ধতি। বিতর্কই হচ্ছে, গণতন্ত্র প্রস্ফুটিত হওয়ার প্রধান শক্তি।

ভারতের নির্বাচনেও নানা অনিয়মের অভিযোগ শোনা যায়। তারপরও নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের একটা আস্থা রয়েছে। মানুষ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ভারত নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। ভারতের দুর্নীতি দমন বিভাগও অনেক শক্তিশালী। বহু বাঘা নেতাকে ধরাশায়ী হতে দেখা যায়। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষে আস্থা পরিলক্ষিত হয়। গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহ, মনোযাগ ও লাগাতার সংগ্রামের মানসিকতার ব্যত্যয় ঘটলেই কেবল অগণতান্ত্রিক শক্তি সামনে চলে আসে। গণতান্ত্রিক কাঠামোর অনুপস্থিতির সুযোগেই সামরিক শাসন, ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি বা কর্র্তৃত্ববাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পৃথিবীর এখনো নানা প্রান্তে কেবল মতপ্রকাশ ও স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য সংগ্রাম করতে হয়, জীবন দিতে দেখা যায়। মনে রাখা দরকার, যে কোনো ধরনের অবদমন অগণতান্ত্রিক শক্তির দুয়ার খুলে দেয়।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলামিস্ট

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION